
* জাতীয় ঐকমত্য গঠনে রাষ্ট্রীয় বৈঠকে পুরুষের আধিপত্য * আগামীর রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ অনুপস্থিতির ছক কাটা হচ্ছে * কোটাবিরোধী আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল * রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নারীর অংশগ্রহণ অনিবার্য * নারী অধিকার এখনও উপেক্ষিত: শামা ওবায়েদ
রাষ্ট্র সংস্কারে উপেক্ষিত নারী
- আপলোড সময় : ০২-০৬-২০২৫ ০৪:৩৬:২৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৬-২০২৫ ০৪:৩৬:২৩ অপরাহ্ন


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে। গণঅভ্যুত্থানের পর নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডায় এখনো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে জাতীয় ঐকমত্য গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ধারাবাহিক বৈঠক ও আলোচনায় নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন দলের নেতাদের অংশগ্রহণে আয়োজিত এসব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক, যেখানে আগামীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণের ছক কাটা হচ্ছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এককথায় বলতে গেলে রাষ্ট্র সংস্কারে এখনো উপেক্ষিত হচ্ছে নারী।
সর্বশেষ গত ২৪ ও ২৫ মে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বিশেষ বৈঠকে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি দলে নারী সদস্য ছিল না বললেই চলে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল পাঠালেও তাতে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিল না। একইদিন জামায়াতে ইসলামীও পুরুষ-প্রধান প্রতিনিধি দল পাঠায়। এই দুই বড় রাজনৈতিক দলের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে প্রতিটি বৈঠকেই নারী প্রতিনিধি ছিল অনুপস্থিত। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বৈঠক কিংবা সাক্ষাতে কোনো নারী প্রতিনিধি সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি দল দুটি।
নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) রাষ্ট্রীয় বৈঠকে অংশগ্রহণের সুযোগ কম পেয়েছে। তবে নারী প্রতিনিধি নিশ্চিতে তাদের প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। গত ২৩ মার্চ একজন নারীসহ গঠিত প্রতিনিধি দল বিভিন্ন সংস্কারের বিষয়ে দলটির লিখিত মতামত ঐক্যমত্য কমিশনের কাছে জমা দেয়। এবং গত ১৯ এপ্রিল ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুইজন নারী সদস্য, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারওয়ার নিভাকে প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যদিও ৬ মে’র বৈঠকে এ ধারা রক্ষা হয়নি। সর্বশেষ ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারার উপস্থিতি দেখা যায়। অন্যদিকে, এবি পার্টি নারীর অংশগ্রহণে কিছুটা অগ্রগামী। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় বৈঠকে তারা অন্তত একজন নারী প্রতিনিধি সঙ্গে রাখে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে তারা নারী প্রতিনিধি সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ, ৭ এপ্রিল এবং ১৫ মে তারিখে ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকার ও বৈঠকগুলোতে পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি ও নারী বিষয়ক সম্পাদক ফারাহ নাজ সাত্তারের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সৃষ্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ অল্প সময়ের মধ্যে বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিকৃতি হয়ে উঠেছিল। পরিণত হয়েছিল সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ, অন্যান্য লিঙ্গপরিচয়ের মানুষ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিভিন্ন জাতি-ধর্ম পরিচয়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপক সাহসী উপস্থিতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই আন্দোলনে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ‘সংস্কার’। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় খুব আলোচনা হচ্ছে, তা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা। কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী গত ১০ মাসেও আমরা দেখছি, বেশির ভাগ উদ্যোগ ও আলোচনা থেকে নারী এবং আন্দোলনের নারী সমন্বয়করা যেন ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপ পারবে কি রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫১ শতাংশ নারীর হিস্যা ও অংশীদারত্বের বিষয়টি সমস্বরে উচ্চারণ করতে হচ্ছে। নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে সংস্কারের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে।
ধারাবাহিকভাবে প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বাম ঘরানার দলগুলোর মধ্যে গণসংহতি আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ-সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি অংশগ্রহণ করে। এর বাইরে এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ বেশ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল অংশ নিলেও, সেখানে নারীর উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। এদের মধ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) পক্ষ থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে সিনিয়র সহ-সভাপতি তানিয়া রব প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি গত ২৭ মার্চ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার প্রস্তাবনার বিষয়ে মতামত জমা দেয়ার সময় পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালীকে সঙ্গে রাখে। এবং ২৯ এপ্রিলের ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে রাশিদা বেগম ও বহ্নিশিখা জামালীকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর বাইরে অধিকাংশ দলই একেবারেই নারী নেতৃত্বকে উপেক্ষা করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বড় দলগুলোর প্রতিনিধি দলের তালিকায় বেশ কয়েকজন রাখা হলেও, ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রে সেটি হয় একজন কিংবা দুইজনের প্রতিনিধি দল। সেই তালিকায় আবার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের নাম থাকে। অর্থাৎ, অধিকাংশ দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেহেতু পুরুষ, তাই রাষ্ট্রীয় বৈঠকে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম। তবে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ছাড়া অন্য ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এই বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নারী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে দলগুলোর আগ্রহ দেখা যায় না। তবে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বড় দলগুলো ছাড়া অন্য দলগুলোর জন্য কখনও একজন, কখনও দুইজন প্রতিনিধির তালিকা রাখা হয়। এর মধ্যে অবশ্যই দলের যারা প্রধান তাদের যেতে হয়। সুতরাং, নারী প্রতিনিধি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে নারীদের জন্য পদ সংরক্ষিত থাকলেও বাস্তবে তাদের মতামতের গুরুত্ব খুব কমই দেয়া হয় এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনীতিবিদ। অনেকে মনে করেন, নারীদের রাখা হয় শুধুই আলঙ্কারিক পদে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও নীতিনির্ধারণী আলোচনায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় অনুপস্থিত। তবে এ বিষয়ে কথা হয় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক-এর সঙ্গে। তিনি বলেন, নারী অধিকারের কথা মুখে বলা হলেও অধিকাংশ দলের গঠনতন্ত্রে সেই অধিকার কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে দেখা যায়, দলের উচ্চ পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে, সেটিও আলঙ্কারিক মাত্র। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে এখনও একটি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এমনকি প্রগতিশীল দলগুলো, যারা নারী অধিকারের পক্ষে সোচ্চার, তারাও দলের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বে নারীদের অংশগ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আলোচনায়ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় না। নারীদের রাজনীতিতে এগিয়ে নিয়ে আসা হয় না।
নারী অধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নারীদের অনুপস্থিতি দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। নারী নেতৃত্বকে সমর্থন জানানো সত্ত্বেও, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বৈঠকে পুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অভাবকে স্পষ্ট করে তুলছে। তারা বলছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে ‘সমতার রাজনীতি’র ধারণা কেবল নীতিগত বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
এ বিষয়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, এটা খুবই হতাশাজনক। নারী রাজনীতিকরা কেবল সাংগঠনিক বা নির্বাচনী কাজেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রেও থাকতে হবে, এটাই হচ্ছে আসল অন্তর্ভুক্তি। বৈঠকগুলো সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। তবে নারী অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘আমরাই পারি’-র প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী অধিকার বলতে শুধু তাদের শিক্ষিত হয়ে চাকরিতে যুক্ত হওয়াকেই বুঝি। কিন্তু তারা যে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা আমরা উপেক্ষা করি। অথচ রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ না থাকলে, সমাজের সাধারণ নারীদের অধিকার নিয়ে কে বলবে? পুরুষদের কাছ থেকে সেটা প্রত্যাশা করা যায় না, কারণ তারাই তো নারীদের কোণঠাসা করে রেখেছে। এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার প্রয়োজন রয়েছে বলে জিনাত আরা হক মনে করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যেহেতু পরিবর্তনের কথা বলছে, তাদের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা। প্রয়োজনে বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে-যেসব দলে নারী প্রতিনিধি নেই, তাদের নারী সদস্যদের সঙ্গে নিয়েই বৈঠকে অংশ নিতে হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, দেশে দীর্ঘদিন সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় আসনে বসলেও এখনও নারী অধিকার উপেক্ষিত। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ছাড়া নারীদের রাজনীতিতে আসতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের শুধু সংরক্ষিত আসনের দিকে ঠেলে দেয়া হয় বলে মন্তব্য করেন রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, সরাসরি আসনে নির্বাচন করতে গেলে নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ